Skip to main content

লিভিং ঈগল সাইফুল আজম



গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই স্মরণ করেছেন ১৯৬৭ সালের তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ইতিহাস। যে যুদ্ধে ইসরায়েলের যমদূত হয়ে হাজির হয়েছিলেন বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর পাইলট সাইফুল আজম সুজা।


সাইফুল আজম পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র যোদ্ধা, যিনি একক ব্যক্তি হিসেবে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার অনন্য রেকর্ড গড়েছেন। একাই নাকানিচুবানি খাইয়েছিলেন বর্বর ইসরায়েলি সেনাদের।


এমন কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশের এই বৈমানিককে সেই সময় ‘নাত আল-সুজাহ’ সামরিক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। এই বীর যোদ্ধার সেই গৌরবময় ইতিহাস হয়তো অনেকেরই অজানা।


সাইফুল আজম সুজা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। এর আগে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালে ১৯৬৭ সালের জুন মাসে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। 


সেই যুদ্ধে অংশ নিতে ইরাকি বিমানবাহিনীতে বদলি হন সাইফুল আজম সুজা। পশ্চিম ইরাকে অবস্থান নিয়ে ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তিনি।


যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৫ দিনের মাথায় গাজা ও সিনাইয়ের কর্তৃত্ব নিয়েছিল ইসরায়েল। জুনের ৫ তারিখে সিরীয় বিমানবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ শক্তি ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েলের বিমান সেনারা।


তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ইসরায়েল পশ্চিমতীর ও জেরুজালেম দখল করে নেয়। দখল করে নেয় সিরিয়ার গোলান মালভূমিও। 


তাদের সামনে বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলিদের যমদূত হয়ে জর্ডানে যান সাইফুল আজম। ৬ জুন আকাশ থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে মিসরীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধ-সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। 




একই দিন বেলা ১২টা ৪৮ মিনিটে চারটি ইসরায়েলি সুপারসনিক ‘ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে’ জঙ্গি বিমান ধেয়ে আসে জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটির দিকে। এবার তাদের লক্ষ্য জর্ডানের ছোট্ট বিমানবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।


সেই সময় ইসরায়েলি সুপারসনিকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো সমকক্ষ বিমান আরবদের ছিল না। তবু ইসরায়েলিদের ঠেকাতে মাফরাক বিমানঘাঁটি থেকে ‘হকার হান্টার’ জঙ্গিবিমান নিয়ে বুক চিতিয়ে উড়াল দেন সাইফুল আজম।


আর সেই হকার হান্টার দিয়েই ক্ষিপ্রগতির দুটি ইসরায়েলি সুপারসনিক ঘায়েল করে ফেলেন বাংলাদেশি বৈমানিক। তার অব্যর্থ আঘাতে ভূপাতিত হয় একটি ইসরায়েলি ‘সুপার মিস্টেরে’। 


আরেক আঘাতে প্রায় অকেজো হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কোনো মতে পালিয়ে ইসরায়েলি সীমানায় গিয়ে আছড়ে পড়ে আরেকটি বিমান। 


সেদিন অকুতোভয় বৈমানিক সাইফুল আজমের অকল্পনীয় বীরত্বের কারণে ইসরায়েলের পুরো পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়। উল্টো নিজেদেরই দুটো বিমান হারায় তারা। এমন বীরত্বের জন্য পুরস্কারস্বরূপ সাইফুল আজমকে ‘হুসাম-ই-ইস্তিকলাল’ সম্মাননায় ভূষিত করে জর্ডান সরকার।


সাইফুল আজমের কাছে ইসরায়েলি বৈমানিকদের ধরাশায়ী হওয়ার পরদিনই তার কৃতিত্বে ইরাকি বৈমানিক দলের কাছে চরমভাবে পরাজিত হয় ইসরায়েল। ৭ জুন ইরাকের ‘এইচ-থ্রি’ ও ‘আল-ওয়ালিদ’ ঘাঁটি রক্ষা করার দায়িত্ব পড়ে এক ইরাকি বৈমানিক দলের কাঁধে। সাইফুল আজম ছিলেন সেই দলের অধিনায়ক।


সেদিন চারটি ‘ভেটোর বোম্বার’ ও দুটি ‘মিরেজ থ্রিসি’ জঙ্গিবিমান নিয়ে আক্রমণ চালায় ইসরায়েল।


একটি ‘মিরেজ থ্রিসি’ বিমানে ছিলেন ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গিডিওন দ্রোর। দ্রোরের গুলিতে নিহত হন আজমের উইংম্যান। তার হামলায় ভূপাতিত হয় দুটি ইরাকি বিমান। পরক্ষণেই এর জবাব দেন আজম।


তার অব্যর্থ টার্গেটে পরিণত হয় দ্রোরের ‘মিরেজ থ্রিসি’। সেই আঘাতের পর বাঁচার উপায় না পেয়ে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধরা দেন ক্যাপ্টেন দ্রোর। পরে ওই যুদ্ধবন্দির বিনিময়ে জর্ডান ও ইরাকের সহস্রাধিক সৈন্যকে মুক্ত করে দেয় ইসরায়েল।


এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রথম ৭২ ঘণ্টায় সাইফুল আজম একটি অনন্য রেকর্ড গড়েন।  ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সর্বোচ্চ চারটি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করেছেন। যে জন্য তাকে ‘নাত আল-সুজাহ’ সামরিক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।


সাইফুল আজমই পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বৈমানিক যিনি চারটি দেশের বিমানবাহিনীর সেনা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই চারটি দেশ হলো- পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক ও মাতৃভূমি বাংলাদেশ।


এছাড়া ৮টি ভিন্ন দেশের আট বাহিনীর বিমান পরিচালনা করেছেন আজম। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, জর্ডান, ইরাক, রাশিয়া, চীন ও নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশের হয়ে বিমান চালিয়েছেন তিনি।


যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য সব অর্জন আর ইতিহাস গড়া সাইফুল আজমকে ২০০১ সালে ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্স বিশ্বের ২২ জন ‘লিভিং ইগলস’-এর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।


সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার যেসব কর্মকাণ্ড বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে গর্বিত করে, সেসব ঘটনার কথা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই অজানা।


অনেকে হয়তো তার পরিচয়ও জানেন না। তিনি পাবনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্যও ছিলেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল ফখরুল আজম তারই ভাই।


কিংবদন্তি এই বীর বাঙালি ২০২০ সালের জুনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। বাংলাদেশি এই বীরকে আজো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন ফিলিস্তিনিরা।

Comments

Popular posts from this blog

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ (Mariana Trench) পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম মহাসাগরীয় খাদ, যা প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম অংশে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের কাছে অবস্থিত। এটি প্রায় ১১,০৩৪ মিটার (৩৬,২০১ ফুট) গভীর, যা মাউন্ট এভারেস্টকে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করলেও উপরে প্রায় ২ কিলোমিটার জায়গা থেকে যেত। অবস্থান: প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত। গভীরতম স্থান: 'চ্যালেঞ্জার ডিপ' (Challenger Deep) হল মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সবচেয়ে গভীর স্থান। উৎপত্তি: এটি দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে গঠিত, যেখানে প্রশান্ত প্লেট ফিলিপাইন প্লেটের নিচে সরে গেছে। চাপ: এখানে পানির চাপ ভূমির বায়ুমণ্ডলীয় চাপের তুলনায় প্রায় ১,০০০ গুণ বেশি । জীববৈচিত্র্য: এই গভীর খাদে অন্ধকারে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রজাতির অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণী পাওয়া যায়, যেমন অ্যাম্পিফডস, অ্যাঙ্গলার ফিশ, এবং দৈত্যাকার অ্যামিবা। গবেষণা ও অভিযান: ১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো জ্যাক পিকার্ড ও ডন ওয়ালশ নামক গবেষকরা 'ট্রায়েস্ট' নামক ডুবোযানে করে চ্যালেঞ্জার ডিপে পৌঁছান। ২০১২ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জেমস ক্যামেরন একক অভিযানে গভীরতম স্থানে পৌঁছে ভিডিও ধ...

বাজাউ: দ্যা সী জিপসি

সমুদ্রে এক যাযাবর জাতি যারা কিনা হাঁটতে শেখার আগেই সাঁতার কাটা শেখে !!  দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অঞ্চলে এমন একটি জাতি বাস করে যারা কিনা বাস্তব অর্থে সমুদ্র শাসন করে ! বড় বড় সামুদ্রিক ঝড়, তুফান এবং সুনামি তাদের কিছুই করতে পারে না, বাস্তব অর্থের তারাই সমুদ্রের রাজা !!  এরা হচ্ছে বাজাউ উপজাতি। সমুদ্রের প্রায় ৭০ মিটার (২৩১ ফুট) গভীরে ডুব দিয়ে নিজ হাতে মাছ ধরে এই উপজাতির লোকেরা ! এরা প্রায় ১৫ মিনিট পর্যন্ত শ্বাস ধরে রাখতে পারে যেখানে কিনা আধুনিক বিজ্ঞান বলে ৫-৬ মিনিটের বেশি অক্সিজেনের অভাবে  বা শ্বাস বন্ধ থাকলে মস্তিষ্ক পুরোপুরি অকার্যকর (Brain Death) হয়ে যেতে পারে। এদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য হোমো স্যাপিয়েন্স থেকে কিন্তু অনেকটাই আলাদা যেমন এদের প্লীহা (spleen) আমাদের থেকে অনেকটাই বড় যার কারণে এরা অধিক সময় শ্বাস আটকে রাখতে পারে !!  এরা বছরের বেশিরভাগ সময় সমুদ্রে ভাসমান নৌকায় বসবাস করে। অনেক বাজাউ জীবনে কখনো স্থলভাগে বা মাটিতেই বাস করেনি !! বাজাউদের করুণ ইতিহাস এই যাযাবর জাতির সামুদ্রিক জীবন যাপনের নেপথ্যে রয়েছে একটি রূঢ় বাস্তবতা। প্রায় হাজার বছর আগের কথা। দক্ষিণ-পূর্ব...

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর সফলতার রহস্য

বর্তমান পৃথিবীর আলোচিত, শক্তিধর রাজনৈতিক ব্যক্তি শি জিনপিং এর জীবনে তার বাবার প্রভাব খুব বেশি। তার বাবাই ছিলেন তার জীবনের সেরা শিক্ষক। তার জীবনের সফলতার একমাত্র রহস্য তার বাবার দর্শন। কী সেই দর্শন?  আসুন জেনে নিই তার জবানিতে।  শি জিনপিন এর আত্মকথা: "আমার বাবার দেওয়া তিনটে উপদেশ আমাকে আজ এখানে পৌঁছে দিয়েছে। ছোটবেলায় আমি খুব স্বার্থপর ছিলাম। সবকিছুতেই নিজের সুবিধে আর লাভটা বুঝে নেবার চেষ্টা করতাম। আমার এই দোষের জন্য আস্তে আস্তে আমার বন্ধুর সংখ্যা কমতে শুরু করল। শেষে অবস্থা এমন হোলো যে আমার আর কোনো বন্ধুই অবশিষ্ট রইল না। কিন্তু, সেই অপরিনত বয়েসে আমি এর জন্য নিজেকে দায়ী না করে সিদ্ধান্ত নিলাম আমার বন্ধুরা আসলে হিংসুটে। ওরা আমার ভাল দেখতে পারে না। আমার বাবা সবই লক্ষ করতেন, মুখে কিছু না বললেও। একদিন রাতে বাড়ি ফিরে দেখি, বাবা আমার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছেন। টেবিলে রাখা আছে রান্না করা ন্যুডলের দুটি ডিশ। একটা ডিশে সেদ্ধ ন্যুডলের ওপর রাখা একটি খোসা ছাড়ানো সেদ্ধ ডিম। অন্য ডিশটিতে শুধু  ন্যুডলসের যে কোনো একটি ডিশ বেছে নিতে বললেন বাবা।  স্বাভাবিক ভাবেই আমি ডিম সমেত ডিশটাই ...